Wallmagazinenarnia
A Multilingual Platform for Budding Authors
Wednesday, 8 March 2017
।।১।।
“...ডুবতে রাজি আছি”
“হ্যাঁ, হ্যালো! জানো, অসাধারণ দৃশ্য। আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত যে এখানে আমি অনেক উপাত্ত পেয়ে যাব। আর জানো, আমি যদি এই ফুলগুলোর নমুনা নিয়ে কাজ করি, তাহলে আমি কত মূল্যবান গবেষণাপত্র লিখতে পারব!... সে আমার জানা নেই। এখানে শুধু তানিয়া আর ধীমান আছে। বাকিরা বোধ হয় অন্যদিকে গেছে।”
মিলা ফোনটা করেছে ওর বাবাকে। হড়বড়িয়ে কথা বলছে। কি যে বলে সে নিজেই জানে। মোট কথা, মিলার কাছে নতুন যা তথ্য আছে, সবই তার বাবাকে দিতে হবে। মিলাদের গবেষণার দলটা তাড়িপুর ইকোপার্কে এসেছে নমুনা সংগ্রহে। গত চার বছর ধরে ও নিজের প্রোফাইল আপডেট করেনি। গাইড পাচ্ছেনা ঠিকঠাক। জাতীয় একটা কর্মশালায় ওর গবেষণার বিষয়বস্তু বেশ প্রশংসিত হয়েছে। কর্মশালার গবেষক বিশেশজ্ঞ্ররাই ওকে আর ওর মতো আরও চারজনকে গাইড করছেন। পরামর্শদাতা আর শিক্ষানবিস মিলিয়ে মোট ৯ জন। মিলার কাজ হল ফুলের পাপড়ির বিন্যাসের ওপর গবেষণা করা।
এসময়টা খুব একটা শীত নয়; খুব একটা গরমও নয়। আশেপাশের গাছগুলো থেকে দারুণ গন্ধ ভেসে আসছে।পাখিগুলোও এসময় গাইয়ে হ’য়ে ওঠে। অনেক বেলা হল বলে ওদের কোনও অজুহাত থাকে না। ওরা আগের দিনের মা-কাকিমাদের মতো ‘দুপুরবেলার কলকলিয়ে আড্ডা দেওয়ার’ আমেজে মত্ত। মিলার তো এসময়টা নিশ্চয় ভাল লাগে। কারন এটা বসন্ত। ওর যে এসময়ে বার তিনেক ঐ জ্বরটা হয়েছিল। এবাবা, মুখে বলতে নেই। রুম্পি বলত, “একে ঠাকুরের আশীর্বাদ বলতে হয়।” রুম্পি স্কুলে পড়েছে একসাথে। তারপর কিজানি কোথায় চলে গেছে! দেখা হয়নি আর। সে না হোক। মিলা গরগরিয়ে বলেই চলছে, বলেই চলছে, “...হ্যাঁ জানো, এদিকে একটা ঝিল মতো কি যেন আছে। লেইক বলনা? সে আরকি। নদী না লেইক জানা নেই। আছা, লেইক আর নদীতে পার্থক্য কি বাবা? ‘ওয়াও’! বাবুই পাখির বাসা দেখা যাচ্ছে বাবা। ওগুলো কি বাবুই পাখির বাসা? ...হ্যালো! হ্যালো...” মোবাইল ফোনের পর্দাটা সামনে এনে দেখল এয়ারটেল-র নেটওয়ার্ক নেই। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, তানিয়া আর ধীমানও নেই। কথা বলতে বলতে কোনদিকে কোথায় চলে এসেছে কিছুই বুঝতে পারল না। পথ হারায় নিতো? বিশ্বাস করতে সাহস হচ্ছে না। ‘প্লিজ গড, হেল্প! ভগবান, বাঁচাও !’ বলে বিরবির করছে। ওর সত্যি এই দুপুরবেলা ভয় করছে। কেউ এসে একা পেয়ে ওকে যদি জোর করে নিয়ে যায়?
“ধীমান-ন-ন! তানিয়া”...চোখে জল এসে পড়েছে। মোবাইলটাকে ঝাঁকড়েও কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা।ওতে নেটওয়ার্ক নেই যে নেই-ই। “বাবা-মা!” কেঁদে কেঁদে চারপাশে তাকাচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই। কোন পথ দিয়ে এসেছে কিছু মনে নেই। মনে করার চেষ্টা করছে, ধীমানরা যখন আশেপাশে ছিল তখন সূর্য কোনদিকে ছিল। লেইকটা কোথায় ছিল। ডুকরে কেঁদে উঠেছে সে। কি করে এত বড় ভুল হয়েছে ওর? এই অচেনা জায়গায় কেউ যদি ওকে খুন করে ফেলে বা কিছু করে? “বাবা!”
একটু একটু করে এগিয়ে এসে একটা পায়ে হাঁটা পথ ধরল। যাই হোক, ওর একটা ভরসা আছে যে ওর চেহারায় একটা মায়ামায়া ভাব আছে। কোনও মাঝবয়েসী কাউকে যদি পেয়ে যায়, ওদেরকে অনুরোধ করে ও ইকোপার্কে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবে।
একটু একটু করে এগিয়ে এসে একটা পায়ে হাঁটা পথ ধরল। যাই হোক, ওর একটা ভরসা আছে যে ওর চেহারায় একটা মায়ামায়া ভাব আছে। কোনও মাঝবয়েসী কাউকে যদি পেয়ে যায়, ওদেরকে অনুরোধ করে ও ইকোপার্কে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবে।
ভগবান আর বাবা-মাকে মনে মনে ডেকে ডেকে, ওর স্বর্গীয় ঠাম্মাকে মনে মনে ডেকেডেকে অনেকখানি পথ এগিয়ে এসেছে। কিন্তু পথ শেষ হচ্ছেনা। বুঝতে পারছেনা বেলা আর কতদূর, পথেরই বা কতদূর বাকি। এমন সময় দূর থেকে একটা আওয়াজ এল কানে। অটোর আওয়াজ হতে পারে। একটু অবাক হল ভ্রম নয়ত? সঙ্গে একটু আশাও মিলল। হাঁটার গতিটা অজানা আগ্রহে আর ভয়ের গুমটে অনেকখানি ধীর হয়ে এল। দেখল একটা নড়বড়ে মোটরবাইক আসছে ওর দিকে, ধুলো উড়িয়ে। যে গতিতে আসছিল, সে গতিটা ধিমে করে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল মোটরবাইকটা। মিলার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পাশ কাটাল। মিলাকে এভাবে রাস্তায় দেখে অবাক হল, নাকি কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল কে জানে; মোটরবাইকের ছেলেটা পাঁচ-ছ’ হাত দূরে গিয়ে ব্রেক কষল। মিলা ওর দিকে শুরু থেকেই তাকিয়ে ছিল। ছেলেটাও মিলার দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই বাইকটা থামাল; পুরোপুরি থামায়নি। স্টার্ট করা ছিল তখনো। মিলা অসহায় ভাবে তাকিয়ে ছিল। ছেলেটা বাইক থেকেই জানতে চাইল, “কিছু বলবেন?”
মিলা সাহায্যের জন্য মরছে। চুপ থাকতে পারল না প্রশ্নটা শুনে। ডুকরে কেঁদে উঠল, “আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। প্লীজ, আমায় হেল্প করুন।” যেদিকে ছেলেটি বাইকটি থামাল, সেদিকে ও এগিয়ে এল। ব্যাপারটা লঘু করতে ছেলেটি বলল, “আপনি কোথায় যাবেন? চলুন আমি এগিয়ে দিচ্ছি। ঘাবড়াবেন না।”
চোখ মুছতে মুছতে মিলা বলল, “তাড়িপুর ইকোপার্কে।” যে লোক ওর পরিচয় না জেনে ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে, তাকে যে অন্তত ভরসা করা যায়, এই বিপদই যেন তাকে সে ভরসা জুগিয়ে দিয়েছে।
ছেলেটি বলল, “ওহ। এদিক থেকে লেইক ধরে ৪৫ মিনিট হাঁটতে হবে। আপনি তো অনেকদূর চলে এসেছেন। বাইক নিয়ে ঢোকা যাবেনা। রিজার্ভ এরিয়া। আর বাইক ফেলে তো আমি যেতেও পারছিনা। বুঝতেই পারছেন। আমি বনতলা যাচ্ছি। একটু ঘুরপথ। চলুন বাইকে করে পৌঁছে দিচ্ছি।”
“থ্যাংকস আ লট।অসংখ্য ধন্যবাদ।” বলে মিলা বাইক-এ উঠে বসলো।
মোবাইলে বারবার নেটওয়ার্ক দেখছে। আসছেনা।ও ছেলেটিকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। অপরিচিতদের ও ভরসা করেনা এত সহজে। এটা তো আর ‘টুইটার’ নয় যে অনলাইন বন্ধু হয়ে গেল। এখনও মনে মনে বাবা-মাকে ডাকছে। চারপাশে বেশ নজর-ও রাখছে। মিলা জানেনা আর কতদূর পথ। বিপদের মাথায় তখন ও জিজ্ঞেস করেনি বাইকে যেতে কতক্ষণ লাগবে।
ছেলেটা যদি অন্যকিছু হয়?এ কেমন কথা রাস্তার পাশে লোকালয়ের কোনও চিহ্নমাত্র নেই।
মিলা জিজ্ঞেস করল, “আমাদের আর কতক্ষণ লাগবে যেতে?”
ছেলেটা বলল, “দু’ঘণ্টা!”
মিলা আঁতকে উঠলো। কি? বাইকটা থামান। প্লীজ বাইকটা থামান। ও খুব নড়াচড়া শুরু করল। টাল সামলাতে না পেরে বাইকটা থামাতেই হল ছেলেটাকে। বিরক্ত হয়ে ছেলেটি বলল, “আপনি কি পাগল? এখানে বাইক এক্সিডেন্ট করলে কে বাঁচাবে আমাদের? দিনের পর দিন পরে থাকব রাস্তায়। পচে যাব। কাক-শকুনে ছিঁড়ে খাবে। শেয়াল-কুকুরে হাড়গোড় নিয়ে যুদ্ধ করবে। আপনি পাগল?”
মিলা এবার আরও ভয় পেল। কেঁদে বলে উঠলো, “প্লীজ আমায় হাঁটা পথেই ইকোপার্কে পৌঁছে দিন। প্লীজ আপনার পায়ে পরি। আমার খুব ভয় হচ্ছে।”
“দুর! ****। যেচে বিপদে পড়া। মেয়েমানুষ নিয়ে (দাঁত কিড়মিড়িয়ে)... দুর দুর!” অনুদৃত অপবাদে ছেলেটি সত্যি বিরক্ত হয়ে উঠেছে। শব্দ খুঁজে পাচ্ছেনা। বাইকটাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে উলটো পথে চলতে শুরু করল। ছ-সাত পা দুমদাম এগিয়ে এসে পিছন ফিরে রাগরাগ গলায় বিমুঢ় মিলাকে বলল, “কি হল? চলুন।”
মিলার দিনটা আজ ভাল পোহায় নি। কতক্ষণ হেঁটেছে, কে জানে। কিন্তু ছেলেটা ভাল হোক, খারাপ হোক, ওকে যে এগিয়ে দিচ্ছে আর বাইকটা ওভাবে ফেলে এসেছে, সেকথা ভেবে কেমন মায়া হল হঠাৎ। মিলাই শুরু করল, “আমি খুব দুঃখিত।”
ছেলেটা বলল, “কেন? কি জন্য?”
আমতা-আমতা স্বরে উত্তর এল, “আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম খুব। আর অচেনা জায়গায় আরও বেশি ভয় পেয়েছি।”
অনেক্ষন প্রত্যুতর আসেনি। মিলা পিছন-পিছন চলছিলো। ছেলেটা এবার কিন্তু সহজ গলায় বলল, “হ্যাঁ। মানুষেরা মানুষদেরকেই বেশী ভয় করে।”
জবাবে মিলা হাসল। হাসিটা ছেলেটা হয়ত দেখেনি। বা হয়ত দেখেছে। হাসিতে স্বার্থপরের মতো ব্যবহার, ভয়, সাহায্যকারীর প্রতি অবিশ্বাসের অনুশোচনা সবই ছিল। ছোটবেলা থেকেই মিলার চরিত্রের সব কটা দিকই আন্দাজ করা যেত। ও কি ভাবে, কেমন, সব কিছুর ছায়া ওর মুখে পরে। ‘ছায়া’ কথাটা মনে আসায় আচমকাই ওর নজর মাটিতে গেল। ছেলেটাকে যে ও অনুসরণ করছে, এই দুপুরের আলোতে ওর ছায়া নেই। ভয়ে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ মুখে এল ওর। আওজটা শুনে ছেলেটা পেছন ফিরে তাকিয়ে মিলার ড্যাবড্যাবে চোখ দেখে অবাক হয়ে গেল। ভূত দেখলে কি এমন হয়? মিলা ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয় তাকিয়ে আস্তে নিজের ছায়ার দিকেও তাকাল। ওরও ছায়া নেই। কি আশ্চর্য! ভূতেদের ছায়া থাকে না। ওর কি হল? ভয়টা এবার অন্য এক অনুভূতিতে রূপান্তরিত হল। অনুসন্ধিৎসা কি? ছেলেটা লক্ষ্য করল মিলার মুখের ছাইছাই ভাবটা এখন নেই। কি যেন কি একটা আছে। আচ্ছা মেয়ের পাল্লায় পড়েছে তো। মিলার কান্ড-কারখানা-ভাবান্তর দেখে ওর স্পষ্ট হল পুরো ব্যাপারটা। “হাঃ হাঃ” করে হেসে উঠলো। মেয়েটির আচরণে ছেলেটি সত্যি এবার মজা পেল। ঐ মজায় একটা মমতার অনুভূতিও ছিল। কিছুক্ষণ হেসে শেষে বলল, “না না। আপনি মারা যান নি। আমরা এখন যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, সূর্য ঠিক মাথার ওপরে আছে আমাদের। এখন আমাদের ছায়া পড়বে না। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ... ”
ধরা পড়ে মিলা একটু লজ্জিত হল, “কিন্তু এখন যে বসন্তকাল?”
ছেলেটি বলল, “তবে আপনি বেঁচে নেই!”
ছেলেটি বলল, “তবে আপনি বেঁচে নেই!”
আড়চোখে দেখে নিল ঘড়িতে সত্যি বারটা বাজে। ও গবেষণার ছাত্রী হলেও এই অচেনা ছেলেটির কাছে আর অপদস্থ হতে ইচ্ছে হলনা, নিজের ছায়া পরখ করে দেখতে। এয়ারটেল-র নেটওয়ার্কটা পেলেই হত। প্রচণ্ড গরম লাগছিল। এই খোলা আকাশের নিচে। সূর্যটা খুব কড়াকড়ি করছে। রাস্তার পাশে বসে পরল মিলা। ওর চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। ছেলেটার মায়া হল খুব। এদিক ওদিক দেখে নিয়ে, একটু দূরের ছোট গাছ থেকে দুটো ডাল ভেঙ্গে আনল। বলল, “একটু জিরিয়ে নিয়ে চলুন উঠা যাক।এই ডালটা রাখুন, ছাতার কাজ দেবে। আমিও রাখছি একটা।”
মিলা অপরিচিতদের কাছে সহসা নিজের পরিছয় দেয়না। ওর রহস্যময়ি হয়ে থাকতেই বেশী ভাল লাগে। ছেলেটি নিজে থেকেই বলল, “আপনি কি করেন? স্টুডেন্ট?”
মিলা, “হ্যাঁ।”
ছেলেটি, “ওহ। আমার নাম রামানুজ। আপনাকে কি বলে ডাকবো?”
মিলা মনে মনে ভাবছে, ‘আপনি-আজ্ঞে’ করলেই ভাল। মুখে বলল, “মিলা”
কিছুক্ষণ পর রামানুজ বলল, “চল উঠা যাক। ‘তুমি’-ই বললাম।”
জবাবে মিলা হাসল। কিন্তু এই ‘তুমি’ বলাটা ওর মোটেও ভালো লাগেনি। আগের মতই রামানুজ সামনে, আর মিলা পিছনে হাঁটতে লাগলো। সন্তর্পণে লক্ষ্য করল এবার একটু একটু ছায়া পড়ছে। এইটুকুন ওর গাছের ডালের পাতার ছাতার ছায়া। ছাতাটা সরাল তো এইটুকুন ওর একমাত্র মাথার ছায়া। ওয়াও! সে বেঁচে আছে। মিলা বেশ খুশী হল। ছেলেটার ডালের ছাতাও মাটিতে ছায়া দিচ্ছে। রামানুজকে জিজ্ঞেস করল ওরা যে পথে যাচ্ছে সেটার নাম কি। রামানুজ জানাল ওটা তালতলা। অনেক তালগাছ ছিল আগে। রামানুজ যখন ছোট ছিল, এই গরমের সময়ে ওদের স্কুলের কর্মশিক্ষার পরীক্ষা হতো আর মেয়ের সব এই তালতলার তালপাতা দিয়ে পাখা বানিয়ে নিতো। ওরা যে পথে বাইক চালিয়ে যাচ্ছিল, একটু দূর এগুলে দেখত খেজুর গাছ। সেটার নাম খেজুরতলা। ঐ অঞ্চলের মেয়েরা কর্মশিক্ষায় বানিয়ে নিতো খেজুরপাতার ব্যাগ। রামানুজের কথা শুনতে শুনতে মিলা ওর ছেলেবেলার স্মৃতিতে হারিয়ে গেল। ছোটবেলায় ওর এক পিসির কাছে এমনি এক ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে ছাতা মাথায় পুতুল মেম দেখেছিল। ওটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে ওর দারুণ লাগত।
রামানুজ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে। বাড়ি এসেছে। বাইরে কোম্পানিতে চাকরি করে। এবার অনেক দিনের পর বাড়ি এসেছে। ছুটি পায়না। কি জানি কবে আবার বাড়ি ফিরবে। এই বাইকটা ওর হায়ার সেকেন্ডারির। বনতলায় একটা ছোট সিনেমাঘর আছে। দুটোর শো দেখবে বলে যাচ্ছিলো। রাস্তাটা ভালো নয়। সাবধানে চালাতে হয়। তাই দেড়-দু ঘনটা লেগেই যায়। আজ রাত বন্ধুর বাড়িতে কাটানোর কথা। কতদিন দেখা হয়না ওদের সাথে। মিলাকে পৌঁছে দিয়ে রামানুজ সোজা চলে যাবে বন্ধুর বাড়িতে। আজ আর সিনেমা দেখবে না। রামানুজ লক্ষ্য করল মিলা বেশ ভালো শ্রোতা। অনেকক্ষণ কোনও কথা বলছেনা। মিলাকে একটু ভমকে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি কিন্তু সত্যিই জানিনা বনতলার নাম ‘বনতলা’ কেন।” মিলা চমকে উঠলো। একবার ওর মুখে প্রশ্নটা এসেছিল। কিন্তু সে চেপে যায়। রামানুজ কি করে জানল? এবার তবে খেয়ালটাকে এতটা পাত্তা দেয়নি। ওর জন্য ছেলেটার সিনেমা দেখা মিস হয়ে গেল। তার ওপর একটু বাজে ব্যবহারের জন্য মিলাকে ‘সরি’ও বলল। ঘরের কাছে এসে ঘরে ফেরার তাড়া যেন আর অনুভব হয়না তেমন করে। এই পথের ধারে অনেক রকম ফুল ফুটে আছে। ওর সাথে কাগজ-কলম নেই নমুনা সংগ্রহের। মোবাইলটার ক্যামেরাও খুব বাজে।মিলার ফুলের প্রতি এত আগ্রহ দেখে রামানুজ মিলাকে তালতলার ওদিকটায় যে বিশাল বনফুলের সাজানো ভাণ্ডার আছে সে ভাণ্ডারের কথা বলল। মিলার তাড়া না থাকলে আজই একবার দেখে যেতে পারে কয়েক রকম প্রজাতির ফুল।
তালতলার তালগাছগুলর নিচে একটা নিচু ঢাল। একটু গড়িয়ে নামলেই নীচে হাজারো সাদা-হলুদ বনফুল। হাল-ফ্যাশানের স্বভাব ওদের। কেউ বাতাসে দুলছে, কেউ রোদে শুয়ে আছে, কেউ প্রজাপতির সাথে লুটুপুটি খাচ্ছে। ওদেরই এক পাশে এক বড় কুলগাছ। টোপাকুল। রামানুজ ছেলেটা ভালো। গাছে উঠে কুল পেরে দিয়েছে। উম। দারুণ মিষ্টি। একটু একটু টক। ভেতরটা বালি-বালি। রুমালে মুছে মুছে একটা একটা করে কুল সে মিলাকে দিচ্ছে। জানতে চাইছে এবারেরটা কেমন খেতে। নিজে কিন্তু একটাও খায়নি। অম্বলের ধাত আছে।‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ এ নেমে এসেছে।এত কথা বলা ছেলে সে আগে দেখেনি। অনেকদিন যেন কথা বলেনি। অনেকদিন যেন কথা বলবে না। রামানুজ সামনের দিকে ইশারা করে বলল, “ঐ যে দেখছিস খোলা মাঠ, বলতো ওটা কি?” মিলা দেখল। রমানুজই বলল, “ওটা কবরখলা। দিন-দুপুরে বা সন্ধ্যা-রাতে ওদিকটায় যেতে নেই। কতজন অপেক্ষা করে থাকে।” ‘একটা ঠাণ্ডা ধারা রক্তের নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে’। মিলার নাকে ধূপকাঠির গন্ধ ভেসে এল মৃদু। চমকে উঠলো। আশেপাশে দেখে নিল একবার। যতই শহুরে হোক না কেন, ভয় তো ভয়ই। রামানুজকে বলল, “তুমি বিশ্বাস কর?”
-“অবিশ্বাসের কি আছে? কিছু তো সত্যিই আছে।” রামানুজ অযথা ভয় দেখিয়ে কথা বলছেনা। ওর স্বরটা ওরকম। ও যেন শুধু তর্ক করার খাতিরেই বলছে। মিলা বলল, “কেমন হয় ওরা?”
রামানুজ, “কি জানি? অশরীরী হয়ত। হয়ত তোর – আমার মতো দেহধারী। বা ধর ঐ বটগাছটার মতো। যখন প্রয়োজন হয় তখন রূপ ধরে। কখনো হাওয়ায় উড়ে। কখনো স্থবির হয়ে ধ্যান করে। ওরা জনবসতিতে থাকে না।”
মিলা, “কেন?”
রামানুজ, “কেন আবার কি? মায়া পড়ে যে।”
মিলা, “তুমি বললেই হল? ভূতের আবার মায়া! ন্যাকা!”
রামানুজ, “কেন হবে না? ওদের মুক্তি নেই বলেই অশরীরী। ওদের অপূরণেচ্ছা আছেনা! শুনিসনি গয়ায় পিণ্ডি দিতে গেলে ওরা হাতে হাতে পিণ্ডী নিতে আসে। ওরা এসে কান্নাকাটি করে।”
মিলা একটু ভয় পেল। বলল, “আর বলনা এখন। আমার ভয় করছে।” রামানুজ মজা পেল মিলার কথায়। মিলার পরিচয়ের ব্যাপারে কোনও আগ্রহ দেখায়নি সে। কোথা থেকে এসেছে। কি নিয়ে পড়ছে, বা অন্য কোনও কিছুই নয়। শুধু একটা মেয়ে পথ হারিয়ে ওর ওপর ভরসা করে আছে, এই দায়িত্বেই যেন ওর সব কৌতূহল। আরও একটু ভমকে দিতে সে বলল, “কেন শুনিস নি, পুরনো গুহা-প্রান্তরে আজও অশরীরীদের কান্না শোনা যায়?”
মিলা আবারো ভয় পাচ্ছে। মরিয়া হয়ে রামানুজকে বলল ওকে তারাতারি পৌঁছে দিতে। ওরা এখন তালতলার নীচে। কেন এসেছে এই অপদার্থটার সাথে? গলায় জোর এনে বলল, “আমায় পৌঁছে দাও প্লীজ।” রামানুজের চোখে কিসের একটা ছায়া পড়েছে। ওর মুখে অন্যরকম একটা আলোছায়া খেলছে। মিলার মন বলছে কিছু একটা ভয়ঙ্কর হতে চলছে। অসহায়ের মতো কেঁদে ফেলল, “প্লীজ আমায় পৌঁছে দিন... প্লীজ হেল্প। বাবা! প্লীজ সেভ মি।” কিছু বুঝে ওঠার আগেই রামানুজ ওর হাত ধরে জোরে ছুটতে লাগল। সম্বিৎ ফিরে পেতে বুঝল, একদল কুকুর ওদের দূর থেকে তাড়া করে আসছে। রামানুজ মিলাকে নিয়ে ঢাল বেয়ে ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু গড়িয়ে নীচে পড়ে গেল। ধুলোয় মাখামাখি হয়ে গেল দুজনেই। কুকুরগুলো আগ্রাসী হয়ে তেড়ে আসছে ওদের দিকেই। মিলার হাত ছুটে গেল রামানুজের হাত থেকে। নিজেকে তুলে নিয়ে মিলার হাত ধরে তুলে নিয়ে সোজা ছুট দিল ঢালের নিচ বরাবর, “ভয়ের কিছু নেই। আমি তো আছি। চল। সামনেই লেইক। লেইকে গিয়ে পড়লে আর ভয় নেই।” ছুটতে ছুটতে কথাগুলো বলল ও মিলাকে। হারানো পথের সন্ধান মেলার আগেই ‘তুই’ যে আবার ‘তুমি’তে গিয়ে পৌঁছেছে, এ বিপদেও সেটা মিলার নজর এড়ায় নি। আর পারছেনা দৌড়ুতে। কুকুরগুলো ওদের দিকে গুলির মতো এগিয়ে আসছে। হিংস্র কুকুরের ডাকের চেয়েও শ্বাসবায়ুর জন্য শরীরের কাকুতি অনেক অনেক বেশী আওয়াজ তুলেছে বনের এই নির্জন রাস্তায়। রামানুজ আঙ্গুল তুলে সামনেই লেইকটা দেখাল। “আর একটু! লেইকটাতে ঝাঁপিয়ে পরলেই হবে।”...
“আমি সাঁতার জানিনা”, মিলার কথা শেষ না হতে-হতেই ওরা লেইকের ধারে চলে এসেছে। রামানুজ মিলাকে পাঁজাকোলা করে ঝাঁপিয়ে পড়লো লেইকের জলে। একগলা জল খেয়ে মিলা যখন মাথাটা জলের ভেতর থেকে তুলল, রামানুজ তখনো ওকে ধরে আছে। কুকুরগুলো পাড়ে দাঁড়িয়ে ‘ঘেউ-ঘেউ’ করছিল। জলে আর নামেনি। ভয়, সাক্ষাৎ মৃত্যু, ওকে নিয়ে একটার পর একটা খেলা করে চলছে। নিস্তেজ হয়ে এসেছে মেয়েটা। মাথার ভারটাও যেন কাঁধ আর বইতে পারছেনা। রামানুজের শরীরে নিজের দেহের ভার এলিয়ে দিয়ে কুকুরগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। কতটা সময় এভাবে কেটেছে খেয়াল নেই। সূর্যটা যেন একটু হেলেছে। লেইকের একপারে ছায়া পড়েছে। এদিকওদিক তাকিয়ে দেখল। ঐ তো ঐ বাঁদিকেই ও দাঁড়িয়ে ছিল। বাবার সাথে কথা বলছিল তখন।ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। রামানুজকে বলতে যাবে,“রামানুজ ঐ তো...” মুখের কথা মিলার মুখেই রয়ে গেছে। রামানুজের দিকে তাকাতে দেখে রামানুজের পেছনে জলের ওপর মিলার ছায়া। মিলা একা ভাসছে। রামানুজের ছায়া নেই। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। জ্ঞান হারাতে হারাতে রামানুজের কোথাগুলো মনে পড়ছিল, “অশরীরী মায়া”। কয়েক সেকেন্ডেই অজ্ঞান হয়ে মিলা ঝিলের জলে ডুবে গেলো।
।।২।।
“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি”
অচেতন মিলাকে লেইকের জল থেকে উদ্ধার করার পরদিন ওদের দল শহরে ফিরে আসে। ইকোপার্কের গেস্ট হাউসে রাতটা কাটায় কোনমতে। কারণ জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পরের ঘটনা ছিল আরও অসহ্য।ধীমান আর অমিতাভ ঝিলের জলে রামানুজের দেহ খুঁজতে নেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু ওখানকার স্থানীয় লোকেরা বলল যে রামানুজের দেহ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ বছর দুয়েক আগে সুমন্তবাবুর ছেলে রামানুজ মোটরবাইকে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। সন্দেহ করা হয়, বন্য শিকারি কুকুরের হাতে ওর মৃত্যু হয়। এ অঞ্চলে যদি কোনো নতুন লোক পথ হারিয়ে ফেলে, মোটরবাইকে এসে একটা ছেলে ওকে পথ দেখিয়ে দিয়ে যায়। অনেকের ধারনা সে রামানুজেরই অশরীরী অস্থিত্ব। কিন্তু সবার কপাল ভাল নয়। দিদিমণির কপালজোর। নয়তো অনেকে কবরখানার পাশে কতবার নিশির খপ্পরে পড়েছে!
সারারাত দুঃস্বপ্ন দেখেছে। একবার মনে হল কে যেন কবরের ওধার থেকে ওকে হাতছানি দিচ্ছিল। নাকে সেই ধূপকাঠির গন্ধ পেল একবার। শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের ঘোরে দেখল একটা মেয়ে সাদা গাউন পরে হাতে ব্যাগ আর মাথায় ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাদা ফুলে ঘেরা এক পাহাড়ের চূড়ায়। মেয়েটাকে দেখে হাসল। মেয়েটাও হাসল। লক্ষ্য করে দেখল মেয়েতির হাতে খেজুরপাতার ব্যাগ আর মাথায় তালপাতার ছাতা। মিলার দিকে এগিয়ে আসছে সে। মেয়েটি কি পাগল? আর একটু এগুলেই তো নীচে পড়ে মরে যাবে! মেয়েটি এগিয়ে আসছে... আর একটু এগিয়ে... নাহ। মেয়েটির চেহেরা দেখে মিলার চোখের ঘুম চলে গেল! মেয়েটি আর কেউ নয়, রামানুজ!
শহরে ফিরে এসে সাগারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মিলা। সাগর পেশায় মনস্তত্ববিদ। সব কথা শুনে মিলাকে বলল, “কিছুদিন তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন। অতিরিক্ত কাজের চাপে এমন হয়।”
মিলা প্রতিবাদ করে, “কিন্তু পুরো ঘটনা এটাই বলছে সে রামানুজ ছিল।আমি ওর সাথেই ছিলাম।”
সাগর ঠাণ্ডা গলায় বলল, “ঘটনাটা এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, তুমি আগেই রামানুজের এই ঘটনা শুনেছ। বা প্রায় একই ধরনের এমন গল্প শুনেছ আগে। তোমার অবচেতন মনে সে ঘটনা ঘুমিয়ে ছিল। তুমি সেদিন হয়ত ফোনে কথা বলতে বলতে নীচে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলে আর তোমার অবচেতন মন তোমায় এই ঘটনাটা স্বপ্নের মত করে দেখায়। তুমি ওকে সত্যি ভেবে নিয়েছ। আরেকটা ব্যাখ্যা হতে পারে যে তুমি সত্যি সেদিন পথ হারিয়ে ফেলেছিলে আর আচমকা এতটাই ভয় পেয়েছ যে তোমার মস্তিষ্ক তোমায় ভয়ের হাত থেকে মুক্তি দিতে নিজে থেকেই রামানুজকে তোমার সামনে এনে হাজির করে, যে রামানুজের কথা তুমি অনেক আগেই কোন না কোন ভাবে শুনেছ। দেখ মিলা, শুধু তোমার সঙ্গেই না তোমার-আমার মত হাজার হাজার সাধারণ মানুষের সাথে এমন ঘটনা কোন না কোন সময় ঘটেই। স্বামী বিবেকানন্দেরও এমন হত। তাঁর মনে হত, ‘আরে,এ ঘটনাটি তো আগেও ঘটেছে। একে তো আগেও আমি দেখেছি’ ইত্যাদি। পরে তিনি এর ব্যাখ্যায় বলেন হয়ত জন্মের আগেই তিনি দেখেছিলেন ভবিষ্যতে তিনি কার কার সাথে দেখা করবেন বা কি ঘটবে, ইত্যাদি। আধুনিক কালের গবেষকদের মতে, আমাদের এসব যে অনুভূতি হয়, তার জন্য দায়ী একধরণের স্নায়ুকোষ। তোমার বেলায়ও তাই হয়েছে। অবচেতন মন তোমায় নিয়ে খেলা করছে। মনকে যুক্তি দিয়ে দমন কর। কল্পনা-থ্রিল এসবের অধীন হ’য়ো না। তুমি আগেই বলেছ রূপকথার গল্প তোমার খুব ভাল লাগে। তুমি নিজে গবেষণার ছাত্রী। আমি যা বলার বলে দিলাম। এবার বাকিটা তোমার ওপর।”
সাগর ঠাণ্ডা গলায় বলল, “ঘটনাটা এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, তুমি আগেই রামানুজের এই ঘটনা শুনেছ। বা প্রায় একই ধরনের এমন গল্প শুনেছ আগে। তোমার অবচেতন মনে সে ঘটনা ঘুমিয়ে ছিল। তুমি সেদিন হয়ত ফোনে কথা বলতে বলতে নীচে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলে আর তোমার অবচেতন মন তোমায় এই ঘটনাটা স্বপ্নের মত করে দেখায়। তুমি ওকে সত্যি ভেবে নিয়েছ। আরেকটা ব্যাখ্যা হতে পারে যে তুমি সত্যি সেদিন পথ হারিয়ে ফেলেছিলে আর আচমকা এতটাই ভয় পেয়েছ যে তোমার মস্তিষ্ক তোমায় ভয়ের হাত থেকে মুক্তি দিতে নিজে থেকেই রামানুজকে তোমার সামনে এনে হাজির করে, যে রামানুজের কথা তুমি অনেক আগেই কোন না কোন ভাবে শুনেছ। দেখ মিলা, শুধু তোমার সঙ্গেই না তোমার-আমার মত হাজার হাজার সাধারণ মানুষের সাথে এমন ঘটনা কোন না কোন সময় ঘটেই। স্বামী বিবেকানন্দেরও এমন হত। তাঁর মনে হত, ‘আরে,এ ঘটনাটি তো আগেও ঘটেছে। একে তো আগেও আমি দেখেছি’ ইত্যাদি। পরে তিনি এর ব্যাখ্যায় বলেন হয়ত জন্মের আগেই তিনি দেখেছিলেন ভবিষ্যতে তিনি কার কার সাথে দেখা করবেন বা কি ঘটবে, ইত্যাদি। আধুনিক কালের গবেষকদের মতে, আমাদের এসব যে অনুভূতি হয়, তার জন্য দায়ী একধরণের স্নায়ুকোষ। তোমার বেলায়ও তাই হয়েছে। অবচেতন মন তোমায় নিয়ে খেলা করছে। মনকে যুক্তি দিয়ে দমন কর। কল্পনা-থ্রিল এসবের অধীন হ’য়ো না। তুমি আগেই বলেছ রূপকথার গল্প তোমার খুব ভাল লাগে। তুমি নিজে গবেষণার ছাত্রী। আমি যা বলার বলে দিলাম। এবার বাকিটা তোমার ওপর।”
সেদিন থেকে মিলা চেষ্টা করেছে তাড়িপুরের চিন্তা মাথা থেকে দূরে সরাতে। শুরুতে একটু কষ্ট হয়েছে। কিন্তু এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে সাগর ঠিকই বলেছে। মিলা নতুন চাকরি করছে। কোম্পানির ‘আর এন্ড ডি’ প্রোজেক্ট এ আছে। আজকে ওকে হেড অফিসে দেখা করতে হবে। কাজ শেষ করে যখন ফিরে আসছিল কর্মচারীদের ক্যাবিনের সামনে দিয়ে, একটা খালি ক্যাবিনের দিকে নজরটা গেল। ডেস্কে রামানুজের ছবি। চোখ ছানাভরা হয়ে গেল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারল এটা রামানুজ নামে একজন কর্মচারীর ছবি জিনি এ অফিসেই চাকরি করতেন। মিলা জানতে চাইল, “তিনি এখন কোথায়?” জবাব পেল, “দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। ম্যানেজমেন্ট ওনাকে বেশ স্নেহ করতেন। তাই আজো হেড অফিসএ তাঁর ছবি রয়ে গেছে। ঐ কেবিনটিতেই একসময় রামানুজ স্যার বসতেন।”
মিলার ভাল লাগছিল না আর। ঘড়িতে প্রায় বারোটা বাজে। বেরিয়ে সোজা চলে এল পার্কিং জোনে যেখানে তার গাড়ি অপেক্ষা করছে। গাড়িতে উঠতে যাবে, এমনি সময় একটা মোটরবাইক প্রায় মিলার গা ঘেঁসে মিলার পাশ কাটিয়ে গেল। মুখ ফিরিয়ে দেখল, বাইকের ছেলেটি সামনের গলিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। ছেলেটি ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। চমকে গেল মিলা।এ আর কেউ নয়, রামানুজ। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসি। মাথাটা কি আবার ওর খারাপ হয়ে যাচ্ছে? সাগারকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল। ওপাশ থেকে ভেসে এল, “ম্যাম! আপনি যাকে ফোন করেছেন, এমাত্র তার মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক। ওনাকে সিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আপনি...” বাকিটুকু মিলা শোনেনি। ওর কানে ভেসে আসছিল কুকুরের বিশ্রী ডাক, ঠিক সে পথ থেকে যে পথে একটু আগে রামানুজের বাইকটা মিলিয়ে গেছে আলতোভাবে।
Subscribe to:
Posts (Atom)